ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার দাদুড়িয়া বিলের ফসলি জমির মধ্যে সিসা কারখানা গড়ে উঠেছে। সিসা কারখানার ফলে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে ওই এলাকার পরিবেশ। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে জীব বৈচিত্র। বিলের চারিপাশের বিশ্বাসপুর, রাজাপুর, কলারন, মধ্যের গাতি, পোয়াইলসহ কয়েকটি গ্রামের মানুষ আছে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, চতুল ইউনিয়নের কলারণ ও বিশ্বাসপুর গ্রামের মাঝামাঝি দাদুরিয়া বিলের ফসলি জমিতে বোয়ালমারী-ময়েনদিয়া পাকা সড়কের পাশে এ সিসা কারখানা গড়ে উঠেছে। চারদিকে প্রাচীর ঘেরা, সামনে লোহার গেট।
কারখানাটির নেই কোন নামফলক। দিনের বেলা নিরব নিস্তব্ধ। গেটের বাইরে থেকে কাউকে ডেকেও সাড়া পাওয়া যায় না। গভীর রাতে গিয়ে দেখা যায়, ভিতরে আগুনের লেলিহান শিখা। আর চারদিকে ব্যাটারি পোড়ানোর এসিডের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। ব্যাটারি পোড়ানোর জন্য খোলা আকাশের নিচে তিনটি চুল্লি আছে। তাতে নেই কোন চিমনী। চুল্লিতে আগুন জ্বলছে। তার ভিতর ব্যাটারি পুড়িয়ে সিসা তৈরি করা হচ্ছে।
সিসা কারখানায় বিভিন্ন স্থান থেকে আশা পুরাতন ব্যাটারির প্লেট, প্লাস্টিকসহ অন্যান্য জিনসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। ১৮ জন শ্রমিক মাস্কবিহিন গামছা বা পাতলা কাপড় পরে সিসা গলানোর কাজ করছে। ব্যাটারি পুড়ানো চুল্লির উপর দিয়ে হাই ভোল্টেজ বিদ্যুতের লাইন টাঙানো রয়েছে।
এতে করে চুল্লির আগুন ও বিদ্যুতের ক্যাবলে আগুন লেগে যে কোন সময় ঘটতে পাড়ে বড় দুর্ঘটনা। অবৈধ এ সিসা কাখানার পাশেই রয়েছে এম এইচ গোল্ডেন জুট মিল। সিসা কারখানার কারণে পথচারী ও জুট মিলের শ্রমিকরা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে।
বিশ্বাসপুর গ্রামের অচিন্ত বিশ্বাস বলেন, বিলের এ পাশের পানিতে মাছ নেই। তাই জেলেরা দক্ষিণ পাশে বিলের মাঝে গিয়ে মাছ ধরছেন। তিনি এ সিসা কারখানা বন্ধ করার জোর দাবি জানান।
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা কবি কাজী হাসান ফিরোজ বলেন, সিসা কারখানা সরাসরি জীব বৈচিত্রের উপর প্রভাব ফেলবে। তাছাড়া মানব দেহের উপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। গলানো সিসা থেকে নির্গত কার্বন ও সিসা পাশের গোল্ডেন জুট মিলের শ্রমিক কর্মচারীদের শরীরে প্রভাব পড়তে পারে। তারা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হতে পারে।
সিসা কারখানায় দায়ীত্বে থাকা ম্যানেজার আলমগীর হোসেন বলেন, বিভিন্ন এলাকা থেকে নষ্ট ও বাতিল ব্যাটারি কিনে আনা হয়। সে ব্যাটারিগুলো কারখানায় এনে ব্যাটারির বিভিন্ন অংশ খুলে আলাদা করে সিসা তৈরি করতে পোড়ানো হয়। এমন খোলামেলাভাবে ব্যাটারি পোড়ানোর জন্য শ্রমিকদের কোন প্রকার ক্ষতি হবে কিনা এমন জানতে চাইলে তিনি বলেন, না তাদের কোন ক্ষতি হবে না। অনেক দিন ধরে তারা এ কাজ করে আসছে।
সিসা কারখানার মালিক মোবাইল ফোনে বলেন, ৫ বছরের চুক্তিতে মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাড়ায় ওই কারখানায় সিসা তৈরির কাজ করা হয়। বাড়ি গাইবান্ধা এলাকায়, কিন্তু বসবাস করেন ঢাকায়। কারখানার জন্য চতুল ইউনিয়নের একটি ট্রেড লাইসেন্স আছে এর বাইরে কোন অনুমোদন নেই কারখানাটির। পরিবেশ ছাড়পত্র নেই। বললেন, দেশে শত শত সিসা কারখানা চলছে। সিসা কারখানায় পরিবেশের কোন ক্ষতি নেই বলে তিনি দাবি করেন।
বগুড়া থেকে আসা অভিজ্ঞ শ্রমিকরা কাজ করে। ১০-২০ বছর ধরে এ সকল শ্রমিকরা কাজ করে আসছে তাদের তো কোন সমস্যা হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, খুলনার হ্যামকো কোম্পানি আমাদের পুরাতন ব্যাটারি দেয়। সেই পুরাতন ব্যাটারি প্রোসেস করে সিসা তৈরি করে ওই কোম্পানিকে দেয়া হয়।
বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এম এম নাহিদ আল রাকিব বলেন, যে কোন বর্জ্যই খারাপ। বর্জ্য ধ্বংস করার যদি বৈধ পন্থা না থাকে তাহলে সেটা ক্ষতি করবেই। সিসা তৈরির কারখানা মানুষ, পরিবেশ এবং জীব বৈচিত্রের জন্য হুমকি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে শিশুদের। শিশুদের মেধা বিকাশে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। গর্ভবতী মহিলাদের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। আর যে সকল শ্রমিক কাজ করে তাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতো রয়েছেই।
ফরিদপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সাইদ আনোয়ার বলেন, বোয়ালমারী থেকে কোন সিসা কারখানা পরিবেশ ছাড়পত্রের জন্য আবেদন করেনি। আর আবেদন করলেও অনুমোদন দেয়া হয় না।
তবে কেউ যদি প্রোপার ওয়েতে সকল নিয়ম-কানুন মেনে কারখানা করে সেক্ষেত্রে ঢাকা থেকে বিবেচনা করলেও করতে পারে। বোয়ালমারীর এ কারখানা সম্পর্কে আমার জানা ছিল না। আমরা অভিযান চালিয়ে অবৈধ ওই সিসা কারখানা ভেঙে দিব।
টিএইচ